Sun, Aug 4, 2019
Read in 6 minutes
TLDR;
বলতে পারেন ইউরোপীয়ান ইউনিয়ন কেন দশ লক্ষ ইউরো এবং হাজার হাজার কর্মঘন্টা খরচ করে পৃথিবীর সবচাইতে গোলাকার একটি সিলিকন গোলক তৈরী করেছে? উত্তর? গ্রাভ।
আসলে গ্রাভ হচ্ছে মেট্রিক পদ্ধতিতে ওজনের মূল একক। যা পরবর্তীতে ১৭৯৩ সালে সিস্টেম ইন্টারন্যাশনাল ডুনিটে বা এস আই ইউনিট হিসেবে প্রবর্তিত হয়। এর প্রবর্তনের মূলে ছিলেন তৎকালীন নামজাদা সব বুদ্ধিজীবি ও বিজ্ঞানীরা, যার মধ্যে ছিলেন এন্টোয়ান ল্যাভয়সিয়ের সহ আরও অনেকে। তারা সর্ব সম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত নেন যে, ওজনের মূল একক হবেঃ
০ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় (বরফের গলনাঙ্ক) ১ ঘন ডেসি মিটার বরফের ওজনের সমান। যার মানে দাড়ায়, ১ লিটার ঠান্ডা পানি। দুটিরই ওজন সমান।
এর নাম গ্রাভ হওয়ার পেছনে রয়েছে ল্যাটিন শব্দ গ্রাভিটাস, অর্থাৎ ওজন। তবে এটি বেশিদিন টেকেনি। এটা শুনতে অনেকটা গ্রাফ এর মতো শোনায়। গ্রাফ এর অর্থ হলো এক/একক। তখন ফরাসি বিপ্লব চরমে এবং সবাই সম অধিকার এর জন্য লড়াই করছিলেন। তাই অাপনি একটি বড় একক করতে তৈরী করতে পারেন না। সবাই চাইছিলেন সামস্টিক গোছের কিছু একটা একক হবে।
অভিজাত/বনেদী ঘরের সস্তান ল্যাভয়সিয়েরকে এর জন্য প্রান দিতে হয়েছিলো গিলোটিনে শিরোচ্ছেদের মাধ্যমে। কারন তিনি শুধু পৃথিবী বিখ্যাত পরিমাপ পদ্ধতি আবিস্কার ই করেন নি। তিনি পেশায় ছিলেন খাজনা সংগ্রহের তহশীলদার ও। তার বিরুদ্ধে তামাক এ ক্ষতিকর পদার্থ মিশিয়ে বিক্রি ও খাজনা চুরির অভিযোগও আনা হয়েছিলো। তাই বলা যায় আসলেই তখনকার সময় ছিলো চরমে। হাইড্রোজেন ও অক্সিজেন এর নামকরন ও তিনি ই করেছিলেন। অনেকে তাকে আধুনিক রসায়নের প্রবর্তক ও বলে থাকেন। তিনি সিলিকনের অস্তিত্ব সম্পর্কে ভবিষ্যৎবানী দিয়ে গিয়েছিলেন ১৭৭৮ সালে। তিনিই প্রথম নিশ্চিত করেন যে, সালফার আসলে একটি মৌলিক পদার্থ, যৌগিক নয়।
অতঃপর নতুন সরকার ক্ষমতায় আসার পর তারা সিদ্ধান্ত নিলেন যে, পরিমাপের জন্য এক গ্রাভ আসলে অনেক বেশী হয়ে যায়। তাই তারা সিদ্ধান্ত নিলেন যে, এক গ্রাভ এর এক হাজার ভাগের এক ভাগ হবে পরিমাপের নতুন মূল একক এবং এর নাম দিলেন “গ্রাম”। কিন্তু কিছুদিন পর অনুধাবন করলেন যে, গ্রাম আসলে মূল একক হিসাবে অনেক ছোট হয়ে গেছে। তাই ওজনের মূল একক গ্রাভ এ ফেরত যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু এর নাম গ্রাভ হলে তো সেই পুরনো পরিমাপ পদ্ধতিতেই ফেরত যাওয়া হয়। অতএব কি আর করা, তারা এর নতুন নাম দিলেন এক হাজার গ্রাম বা এক কিলোগ্রাম।
এজন্যই সাত ধরনের এস আই ইউনিট এর এককের মধ্যে একমাত্র কিলোগ্রাম এরই আছে একটি উপসর্গ; কিলো।
১। মোল (পরিমাণ)
২। কেলভিন (তাপ)
৩। ক্যান্ডেলা (আলোর তীব্রতা)
৪। সেকেন্ড (সময়)
৫। এম্পিয়ার (কারেন্ট/তড়িৎ প্রবাহ)
৬। মিটার (দৈর্ঘ্য)
৭। কিলোগ্রাম (ভর/ওজন)
১৭৯৯ খৃষ্টাব্দে এটি আবার পূণঃ নির্ধারিত হয়। যা হচ্ছঃ ৪ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় এক লিটার পানির ওজনের সমান।
উল্লেখ্য, ৪ ডিগ্রী তাপমাত্রায় পানির ঘনত্ব সবচেয়ে বেশী হয়ে থাকে। কিন্তু প্রমান ওজন হিসাবে ব্যবহারের জন্য পানি ততটা গ্রহনযোগ্য নয়। তাই তারা প্লাটিনাম দিয়ে একটি সিলিন্ডার তৈরী করলেন যা এক লিটার পানির ওজনের সমান। এবং এটির নাম দিলেন কিলোগ্রাম। পরবর্তীতে এটি সরকারী কোষাগারে সংরক্ষন করলেন। এখানে উল্লেখ থাকে যে কিলোগ্রাম এখন আর পানির আয়তনের সাথে সম্পর্কিত নয়।
৯০ বছর পর ১৮৮৯ খৃষ্টাব্ধে এই কিলোগ্রাম পূণরায় নির্ধারন করা হয় একটি প্লাটিনাম-ইরিডিয়াম এর শংকর ধাতুর তৈরী সিলিন্ডার দিয়ে। এখন এটি অনেক শক্ত কিন্তু দেখতে একই রকম। অদ্যাবধি এটিই হলো কিলোগ্রাম এর প্রমান একক। যার নাম “International Prototype Kilogram” অনেকেই মজা করে একে লা গ্রান্ড কে বা বড় কে বা আইপিকে ও বলে থাকেন। এবং এটি দেখতে এরকম।
এস আই ইউনিট পদ্ধতিতে এটি ই একমাত্র একক যা একটি বাস্তব পদার্থের সাথে সমতূল্য। এটি রাখা আছে তিনটি কাঁচ এর জার এর ভিতরে। নিশ্চয়তার জন্য একই সাথে ছয়টি নমুনা একটি সিন্দুকে রাখা হয়। এর আবহাওয়া ও তাপমাত্রায় অতি মাত্রায় নিয়ন্ত্রিত। এই ছয়টি জার রাখা আছে এমন প্রতিটি সিন্দুকের মধ্যে তিনটি জটিল তালা দেওয়া আছে। এই সিন্দুক প্যারিস এ আন্তর্জাতিক পরিমাপ বুর্যর মূল কার্যালয়ের পাতালে রাখা আছে। এখন কেউ যদি এই সিন্দুক ভেঙে কিলোগ্রাম কে বিকৃত করে দেয় তা সারা পৃথিবীর পরিমাপ পদ্ধতি নষ্ট করে দিতে পারবে। কিন্তু না। কারন এটি তৈরীর সময় ৪০ টি রেপ্লিকা তৈরী করে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পরিমাপের একক হিসেবে পাঠিয়ে দেয়া হয়। সব দেশেই সংরক্ষনের পদ্ধতি ছিলো এক।
১৯৪৮ সালে কিলোগ্রাম একক গুলো বিভিন্ন দেশ থেকে ফেরত নিয়ে আবার পরিমাপ করা হয়। তখনই দেখা দেয় এক নতুন সমস্যা। যদিও এটি রাখা হয়েছিলো একই ধরনের সিন্দুক ও জারের মধ্যে। এমনকি একই সিন্দুকে রাখা ছয়টি জারের কিলোগ্রাম গুলোও পরিমাপ করে বড় ধরনের তারতম্য দেখা যায়। যার পরিমান ০.৫০ মাইক্রোগ্রাম এর মতো। আনুমানিক একটি আঙ্গুলের ছাপের ওজনের সমান। কিন্তু আঙ্গুলের ছাপ আসলে এর জন্য দায়ী নয়। কারন এটি পরিমাপের পূর্বে যত্ন সহকারে ধুয়ে নেওয়া হয়েছিলো।
ঠিক কি কারনে ওজনের এই তারতম্য হয়েছিলো তা এখনও নিশ্চিত জানা যায়নি; তবে এটি পরিস্কার যে প্লাটিনাম-ইরিডিয়াম এর যৌগের ওজন সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তন হয়। এটি পরিমাপের জন্য একটি বড় সমস্যা। কারন সাতটি একক এর চারটি ই কিলোগ্রাম এর উপর নির্ভরশীল।
১। মোল
২। ক্যান্ডেলা
৩। এম্পিয়ার
৪। কিলোগ্রাম
বলা বাহুল্য যে, অন্যান্য কিলোগ্রাম ভিত্তিক একক যেমন নিউটন, জুল, ভোল্ট এবং ওয়াট ও এর উপর নির্ভরশীল।
লাইবেরিয়া, বার্মা এবং ইউএসএ যারা মেট্রিক পদ্ধতি গ্রহণ করেনি, তাদের একক আভয়রডিপাও পাউন্ড যা কোন বাস্তব পদার্থের উপর নির্ভরশীল নয। এর পরিবর্তে তারা এক কিলোগ্রাম এর ০.৪৫৩৫৯২৩৭ অংশকে আভয়রডিপাও পাউন্ড হিসাবে নির্ধারন করেছে। তাই এই কিলোগ্রাম এর তুলনা কোন বাস্তব পদার্থের উপর নির্ভরশীল হতে পারেনা।
এই খানেই আমাদের সেই সিলিকন গোলক তৈরীর জন্য দশ লক্ষ ইউরো এবং হাজার হাজার কর্মঘন্টা খরচ এর যৌক্তিকতা নিহিত। কিন্তু অাপনি হয়তো বলবেন এই সিলিকন গোলক ও তো একটি বাস্তব পদার্থ ই। এ আর নতুন কি হলো?
এই গোলকটি তৈরী হয়েছে সিলিকন-২৮ নামের একটি আইসোটোপ দিয়ে। তাই এই গোলকের মধ্যে কোন ফাপা জায়গা নেই। এটি শুধু খাটি সিলিকন ই নয়, এটি অাসলে শুধু সিলিকন-২৮ দিয়ে তৈরী। এর জন্যই এই গোলকের দাম এত বেশী। তাই আমরা গুনতে পারবো যে এই গোলকের মধ্যে কয়টি অনু আছে। প্রশ্ন আসতে পারে যে এটি কেন গোলাকার হতে হবে?
কারন আমরা বৃত্তের ব্যাস জানলে তা থেকে গোলকের আয়তন সহজেই বের করতে পারি এই সমীকরন দিয়ে।
এর মাধ্যমে আমরা এভোগ্যাড্রোর ধ্রুবক পূণরায় নির্ধারন করতে পারি। বর্তমানে এভোগ্যাড্রোর ধ্রুবক বলতে বুঝায়ঃ
১২ গ্রাম কার্বন-১২ এর মধ্যে যে কয়টি অনু রয়েছে তাই হলো এভোগ্যাড্রোর ধ্রুবক। কিলোগ্রাম এর একক হিসেবে যা উল্টোভাবে এভোগ্যাড্রোর ধ্রুবক দিয়েও বের করা যাবে। এভাবে এভোগ্যাড্রোর ধ্রুবক ও কিলোগ্রামে মোট অনুর পরিমান একে অপরকে সঠিক প্রমান করে।
তাই বর্তমানে কিলোগ্রাম এর সঠিক সংজ্ঞা হলোঃ
২.১৫x১০^২৫ টি সিলিকন-২৮ অনুর ওজন ই হলো এক কিলোগ্রাম।
অতএব আমরা বলতে পারি এই সিলিকন গোলক হারিয়ে গেলেও কিলোগ্রাম এর মান এর কোন পরিবর্তন হবেনা কারন এটি এখন একটি ধারনার উপর নির্ভরশীল। কোন বাস্তব পদার্থের উপর নয়।
কিলোগ্রাম পরিমাপের জন্য আরও একটি পদ্ধতি আছে যাকে বলে ওয়াট ব্যালেন্স। এটি প্লাঙ্ক এর ধ্রুবক এর উপর নির্ভরশীল। বস্তুত এই পদ্ধতি এভোগ্যাড্রোর ধ্রুবক এর সত্যতাই প্রমান করে। এই দুটি পদ্ধতি একে অপরের সম্পুরক। এটি বর্তমানে কীবল ব্যালেন্স নামে পরিচিত।
ওজন এর একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো মধ্যাকর্ষণ শক্তি; যা স্থান ভেদে ভিন্ন রকম হতে পারে। ভূপৃষ্ঠের একেক জায়গার স্তরের গঠন একেক রকম তাই মধ্যাকর্ষণ শক্তি ও ভিন্ন হয়ে থাকে। প্লাঙ্ক এর ধ্রুবক দিয়ে ওয়াট ব্যালেন্স এ ওজন করার সময় স্থিতিশীল ও গতিশীল উভয় অবস্থায়ই পরিমাপ করা হয়। এছাড়াও এই পদ্ধতিতে অালো, চৌম্বক ক্ষেত্র ও ব্যবহার হয়ে থাকে। তাই এটি আরও বেশী নিখূত। ২০১৯ সালে এটি চূড়ান্ত হবার কথা রয়েছে। পরবর্তিতে আমরা এটি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করতে চেষ্টা করবো।